মানবজীবনের প্রতিটি ধাপের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে নানা আচার-অনুষ্ঠান। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি ঘটনাকে বাঙালি সমাজে উৎসবের মাধ্যমে পালন করা হয়। তার মধ্যে অন্যতম হলো অন্নপ্রাশন—যেখানে শিশুকে প্রথমবার ভাত খাওয়ানো হয় পূজার মাধ্যমে। এই অনুষ্ঠান শুধু খাদ্যাভ্যাসের সূচনা নয়, বরং শিশুর শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির প্রতীক।
অন্নপ্রাশন কি?
অন্নপ্রাশন শব্দের অর্থ হলো—“অন্ন গ্রহণ”। সাধারণত ছয় মাস বয়সের কাছাকাছি সময়ে যখন শিশুর দাঁত গজাতে শুরু করে এবং সে মায়ের দুধের পাশাপাশি শক্ত খাবার খাওয়ার উপযুক্ত হয়, তখন পরিবারে আয়োজন করা হয় এই অনুষ্ঠান। ছেলেশিশুর ক্ষেত্রে সাধারণত ষষ্ঠ মাসে এবং মেয়েশিশুর ক্ষেত্রে পঞ্চম মাসে পালন করার রীতি প্রচলিত।
প্রাচীন বেদীয় উল্লেখ
• গৃহ্যসূত্র ও ধর্মশাস্ত্রে অন্নপ্রাশন – বেদ-উত্তরকালের গৃহ্যসূত্রে অন্নপ্রাশনকে “ষোড়শ সংস্কার” (মানুষের জীবনের ১৬টি প্রধান ধর্মীয় আচার) এর অন্তর্ভুক্ত বলা হয়েছে।
• মনুস্মৃতি – মনুস্মৃতিতেও অন্নপ্রাশনের উল্লেখ রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, শিশুকে প্রথমবার ভাত খাওয়ানোর সময় মন্ত্রপাঠ ও দেবতাদের আহ্বান করতে হবে।
• অর্থ – প্রাচীন ভারতীয়রা বিশ্বাস করতেন, প্রথম অন্ন শিশুর ভবিষ্যৎ দেহ-মন গঠনে বিশেষ প্রভাব ফেলে। তাই একে পূর্ণ আচার মেনে করা জরুরি।
ধর্মীয় ব্যাখ্যা
• অন্নই ব্রহ্ম – বেদে বলা হয়েছে, “অন্নং ব্রহ্ম” অর্থাৎ অন্নই ব্রহ্ম। তাই প্রথম অন্নগ্রহণকে পবিত্র করে পূজার মাধ্যমে সূচনা করা হয়।
• দেবতার আশীর্বাদ – অনুষ্ঠানে দেব-দেবীর পূজা করা হয় যাতে শিশুর জীবনে অন্নের অভাব না হয় এবং সে সুস্থভাবে বেড়ে ওঠে।
• পূর্বপুরুষের প্রতি শ্রদ্ধা – অনেক পরিবারে এই সময়ে পিতৃপুরুষদের নাম স্মরণ করা হয়। বিশ্বাস করা হয়, তাঁদের আশীর্বাদে শিশুর জীবনে সমৃদ্ধি আসে।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যাখ্যা
শিশুর সামাজিক পরিচিতি – অন্নপ্রাশনের মাধ্যমে শিশুকে সমাজে আনুষ্ঠানিকভাবে খাদ্যগ্রহণকারীরূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আত্মীয়-স্বজনকে নিমন্ত্রণ করে অনুষ্ঠানের সামাজিক বন্ধন আরও দৃঢ় করা হয়।
উৎসবের আনন্দ – বাঙালি জীবনে প্রতিটি আচার উৎসবমুখর। এই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে পারিবারিক মিলনমেলা ঘটে, যা সমাজ-সংস্কৃতির অংশ।
ভবিষ্যৎ ইঙ্গিত – কিছু পরিবারে অন্নপ্রাশনের সময় শিশুর সামনে কলম, বই, টাকা, গয়না ইত্যাদি রাখা হয়। শিশু যেটি বেছে নেয়, সেটিকে তার ভবিষ্যৎ প্রবণতার প্রতীক হিসেবে ধরা হয়।
বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা
• শারীরবৃত্তীয় প্রস্তুতি – ছয় মাস বয়সের পর থেকে শুধু মায়ের দুধ শিশুর পুষ্টির জন্য যথেষ্ট হয় না। এ সময় শিশুর শরীর অতিরিক্ত শক্তি ও পুষ্টি চায়, তাই প্রথমবার শক্ত খাবার শুরু করার জন্য এই সময়কে বেছে নেওয়া হয়।
• রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি – ধীরে ধীরে নতুন খাবারের সঙ্গে শরীরকে মানিয়ে নিতে হয়। অন্নপ্রাশনের মাধ্যমে শিশুকে শক্ত খাবারের জগতে প্রবেশ করানো হয়, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে সহায়ক।
• পরিবারের অংশগ্রহণ – বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এটা গুরুত্বপূর্ণ যে, শিশুর খাদ্যাভ্যাসের সূচনায় পরিবার সকলে মিলে মনোযোগ দেয়। এতে অভিভাবকরা শিশুর খাদ্যগ্রহণের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে।
অন্যান্য সংস্কৃতির সঙ্গে তুলনা
• চীনে – চীনে শিশু ছয় মাস বা এক বছর পূর্ণ করলে “Zhuazhou” নামে একটি অনুষ্ঠান হয়, যেখানে শিশুর সামনে নানা জিনিস রাখা হয়। যা ধরে, সেটি তার ভবিষ্যতের প্রতীক বলে মনে করা হয়।
• জাপানে – জাপানে “Okuizome” নামক একটি অনুষ্ঠান আছে। শিশুর জন্মের ১০০ দিন পর তাকে প্রতীকীভাবে খাবার খাওয়ানো হয়, যাতে সারাজীবন তার অন্নের অভাব না হয়।
• পশ্চিমে – পাশ্চাত্য দেশে শিশুর প্রথম খাবার শুরু করার নির্দিষ্ট কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান নেই, তবে পরিবারিক উৎসব হিসেবে “baby’s first solid food” কে অনেকেই গুরুত্ব দিয়ে পালন করে।
অন্নপ্রাশন শুধু একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি শিশুর জীবনে নতুন অধ্যায়ের সূচনা। এখানে ধর্মীয় বিশ্বাস, সামাজিক রীতি, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ এবং বৈজ্ঞানিক যুক্তি—সবকিছু একসাথে মিশে আছে। প্রাচীন বেদীয় শাস্ত্রের উল্লেখ থেকে শুরু করে আধুনিক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পর্যন্ত—সবই প্রমাণ করে যে এই আচার শুধু কুসংস্কার নয়, বরং শিশুর সুস্থ ও সমৃদ্ধ জীবনের ভিত্তি স্থাপনের একটি উপায়।