(ভিত্তি: সুশ্রুত সংহিতা, চরক সংহিতা এবং অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থ)
প্রাচীন ভারত ছিল চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশ্বে অগ্রগণ্য। প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি মূলত আয়ুর্বেদের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল, যার দুটি প্রধান শাখা ছিল –
চিকিৎসা (medicine) – যার মূল গ্রন্থ চরক সংহিতা
শল্য চিকিৎসা (surgery) – যার মূল গ্রন্থ সুশ্রুত সংহিতা
বিশেষত শল্য চিকিৎসায় (surgery) প্রাচীন ভারতীয়রা অসাধারণ অগ্রগতি করেছিল। সুশ্রুতকে “সার্জারির জনক” (Father of Surgery) বলা হয়।
প্রাচীন চিকিৎসা সরঞ্জাম:
সুশ্রুত সংহিতা তে প্রায় ১০১টি ধাতব অস্ত্রোপচার সরঞ্জাম (যেমন চিমটি, ছুরি, সুই ইত্যাদি) এবং ২০টি non-metallic instrument এর বর্ণনা আছে।
কিছু উদাহরণ:
কার্নী (Karni) – কাঁচি জাতীয় যন্ত্র, কান বা নাকের অপারেশনে
উৎসাধন (Utsadana) – ক্ষত বা ফোড়ার পুঁজ বের করতে
শর্য (Sharri) – ছোট ছুরি
বেতস্য (Vetasya) – তীক্ষ্ণ ছুরি, চর্ম রোগ বা ক্ষত কাটা
সুচী (Suchi) – সূচ, সেলাই করার জন্য
আর্তু (Artru) – হাড় কেটে ফেলার যন্ত্র
স্বস্তিক (Swastika) – হাড় ধরে রাখার যন্ত্র
ত্রিকূটী (Trikurti) – তিন মাথার চিমটি
তাল্য (Talya) – হাতুড়ি জাতীয় যন্ত্র
তখনকার সরঞ্জামগুলো প্রধানত লোহা, তামা ও ব্রোঞ্জ দিয়ে তৈরি হতো, এবং সরঞ্জামগুলো sterilize করার জন্য আগুনে বা গরম জলে সিদ্ধ করত।
অপারেশন পদ্ধতি:
প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসকরা বিভিন্ন ধরনের অপারেশন করতেন, যেমন:
রাইনোপ্লাস্টি (নাক পুনর্গঠন) – তখন যুদ্ধ বা শাস্তিস্বরূপ নাক কেটে ফেলার প্রচলন ছিল; সুশ্রুত এই নাক গঠন নতুন করে করতেন কপালের চামড়া কেটে এনে।
কাটারি চিকিৎসা (Excision) – টিউমার বা গুটিল কেটে ফেলা।
ক্যাথারাইজেশন (Cauterization) – আগুন বা গরম ধাতু ব্যবহার করে ক্ষত বা রক্তপাত বন্ধ করা।
এবসেস ও ফোড়া ফোঁড়ানো – Utsadana ইত্যাদি যন্ত্র দিয়ে।
ক্লিনজিং অফ ব্লাড ও পুঁজ – যাতে ক্ষত দ্রুত শুকায়।
চোখের ছানি অপারেশন (Couching technique) – চোখের লেন্স সরিয়ে ছানি কমানো।
সার্জারি করার সময় তারা নানা ধরণের ঔষধি (ভেষজ) ব্যথানাশক ও অ্যান্টিসেপটিক ব্যবহার করত, যেমন: মধু, ঘৃত, হরিদ্রা (হলুদ), তুলসী ইত্যাদি।
অ্যানাস্থেসিয়া ও প্রাক-অপারেটিভ কেয়ার:
অপারেশনের আগে রোগীকে মদজাতীয় পানীয় বা বিশেষ ভেষজ মিশ্রণ খাওয়ানো হতো, যাতে সে অচেতন বা ব্যথাহীন থাকে।
এছাড়া অপারেশনের পর ক্ষত ধোয়া হতো গরম জল বা ভেষজ ক্বাথ দিয়ে।
শিক্ষাব্যবস্থা:
সুশ্রুত সংহিতা অনুযায়ী, ছাত্রদের গুরুর কাছে সরাসরি হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ নিতে হতো।
শল্যবিদ্যা শিখতে মৃতদেহে প্র্যাক্টিস করা বাধ্যতামূলক ছিল।
গাছের খোসা, কুমড়ো বা তালের পাতা কাটার মাধ্যমে কেটে সেলাই শেখানো হতো।
প্রভাব ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব:
• সুশ্রুত সংহিতা লাতিন, আরবি, ফার্সি ও অন্যান্য ভাষায় অনূদিত হয়েছিল।
• মধ্যযুগীয় ইউরোপের চিকিৎসা বইগুলোতেও এর প্রভাব দেখা যায়।
• আজকের প্লাস্টিক সার্জারির একেবারে গোড়ার ভিত্তি রাখা হয়েছিল তখনই।
প্রাচীন ভারতের চিকিৎসা ও সার্জারি শুধু প্রযুক্তিগত কৌশল নয়, বরং বিজ্ঞান, নৈতিকতা, ধৈর্য ও শুশ্রূষার মিশ্রণ ছিল।
সুশ্রুত ও তার সমসাময়িক চিকিৎসকেরা আমাদের এমন এক ঐতিহ্য উপহার দিয়েছেন, যা আজও বিশ্বের চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
No comments:
Post a Comment