এটি আমার লেখা নয়। whatsapp থেকে নিয়েছি। খুব ভালো লেখা। খুব informative.সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে এখানে বিনা অনুমতিতে post করলাম। প্রসঙ্গত বলি, শ্রীগুরু দেবানন্দ ও নাদ্রা কৃষ্ণ পুর বর্ধমানেও 1st January এই।দিন দিব্য মিলন উৎসব করছেন। বঙ্গবাসী ও ভারতের কাছে এই এক নতুন ধারার সুচনা হয়েছে আগমী যুগের জন্য। 1st January কে নিয়ে জের করে পাওয়া।*****************
#তোমাদেরচৈতন্যহোক
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস , আমাদের প্রাণের ঠাকুরের প্রকটলীলার শেষ লীলাস্হল কাশীপুর উদ্যানবাটী ।
কাশীপুর উদ্যানবাটী ছিল বিশিষ্ট জমিদার রানি কাত্যায়নীর জামাই গোপাল লাল ঘোষের সম্পত্তি। ঠাকুরের ভক্তগণ তাঁর কাছ থেকে মাসিক ৮০ টাকা ভাড়ায় প্রথমে ছয় মাস ও পরে আরও তিন মাসের জন্য বাড়িটি ভাড়া নিয়েছিলেন। উদ্যানবাটীর মোট এলাকার আয়তন ছিল ১১ বিঘার কিছু বেশি।
বাগানটি চার দিকে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। উত্তর সীমানার কাছে কয়েকটি ঘর রান্নাঘর ও ভাণ্ডারঘর হিসেবে ব্যবহৃত হত। এই ঘরগুলির সামনেই মূল দোতলা বাড়িটি অবস্থিত। এই বাড়ির নিচে চারখানি ও উপরে দুখানি ঘর আছে। উপরের বড়ো ঘরটিতে থাকতেন ঠাকুর আর ছোটো ঘরটি তাঁর স্নান ইত্যাদির জন্য ব্যবহৃত হত। বড়ো ঘরটি এখন মঠের প্রধান উপাসনালয়। বড়ো ঘরটির ঠিক নিচে একতলায় একটি হল ঘর আছে। এটি ছিল ভক্তদের বসার ঘর। এখন এটি মঠের দ্বিতীয় উপাসনালয়। এই ঘরের উত্তরে একটি সিঁড়ির ঘর আছে। তার পাশে পূর্বদিকের ঘরটিতে মা থাকতেন। এই ঘরটি এখন মা সারদা দেবীর মন্দির। হল ঘরের দক্ষিণের ঘরটিতে সেবকরা থাকতেন। এটি এখন একটি ক্ষুদ্র সংগ্রহালয়।
মূল বাড়ির পূর্বে ও পশ্চিমে সিঁড়ি আছে। বাড়িকে চার দিক দিয়ে ঘিরে আছে গোলাকার পথ। বাগানের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে উদ্যানবাটীর প্রধান ফটকটি অবস্থিত। এগুলি ছাড়াও বাগানে একটি ডোবা ও একটি বড়ো পুকুর ছিল। বাগানে আম, কাঁঠাল , লিচু ইত্যাদি নানা ফলের গাছও আছে। বাগানের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে বড়ো পুকুরটির পাশে একটি খেজুর গাছ ছিল। তাঁর ভক্ত ছেলেরা ভোরবেলা খেজুর রস খাওয়ার জন্য সেখানে গেলে অলৌকিক উপায়ে এই গাছের তলা থেকে একটি প্রচন্ড বিষধর সাপকে ঠাকুর তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এই গাছটির অবশিষ্টাংশ এখন মঠের অফিসঘরে রক্ষিত আছে।
এখানেই ঠাকুর আট মাস মতো অবস্হান করেন । ব্যাধি তাঁর পার্থিব দেহকে জীর্ণ , ভগ্ন করে দিলেও তিনি পরবর্তী মহীরূহের বীজ বপন করে অঙ্কুরিত করে দিয়েছিলেন এখানেই । ঠাকুর দক্ষিণেশ্বরে মায়ের কাছে এবং ভক্তদের কাছে বলেছিলেন , যাবার আগে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়ে যাব । জানো তো রাজা তাঁর রাজ্যে ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়ান , তারপর লোক জানাজানি হচ্ছে দেখলেই সেখান থেকে সরে পড়েন , তেমনি যখন বেশি লোকে কানাকানি করবে ( নিজের শরীর দেখিয়ে ) এই খোলটা আর থাকবে না , মায়ের ইচ্ছায় ভেঙে যাবে । কারা অন্তরঙ্গ , কারা বহিরঙ্গ তাও জানা যাবে !
নরেন্দ্রনাথসহ অন্যান্য ভক্তগণ , এমনকি মা স্বয়ং এইসব ভবিষ্যৎবাণীর সত্যতা চাক্ষুষ করে আতঙ্কিত হতেন । ঠাকুর নরেন্দ্রনাথকে এই সময়েই বিশেষভাবে পরবর্তীকালের কাজে এগিয়ে দিলেন , বললেন , মা তোকে তাঁর কাজ করবার জন্যেই সংসারে টেনে এনেছেন , তুই আর যাবি কোথায় ----- আমার পেছনে যে তোকে ফিরতেই হবে । এরা সব ( বালক ভক্তদের দেখিয়ে ) হোমাপাখির শাবক যেন , হোমাপাখি আকাশে অনেক উঁচুতে উড়ে ডিম পাড়ে । ডিম প্রবল বেগে মাটিতে পড়তে থাকে , ভয় হয় মাটিতে পড়ে ফেটে গেল বুঝি । কিন্তু তা হয় না , মাটিতে পড়ার আগেই ডিম ফুটে ছানা বেরোয় আর ডানা মেলে উড়তে শুরু করে , মাটি স্পর্শ করে না । তেমনি এরা সব সংসারে আবদ্ধ হবার আগেই ঈশ্বরাভিমুখী হবে ।
এতদিন ভক্তরা চাঁদা তুলে ঠাকুরের সেবার ব্যবস্থা করছিল । ঠাকুর এবার বলরাম বসুকে ডেকে বললেন , দেখ দশজনে চাঁদা তুলে আহারের ব্যবস্থা করবে এ বড়ো পছন্দ হয় না , এখন থেকে খাবার খরচটা তুমিই দিও ।
ভাড়া আশি টাকা ---- জানতে পেরে ঠাকুর ভাবছেন কি করে এরা চালাবে ---- পরম ভক্ত সুরেন্দ্রনাথকে বললেন , দেখ সুরেনদর এরা সব কেরাণী , মেরাণী ছা পোষা লোক । অত টাকা কেমন করে যোগাড় করবে । তুমি ভাড়ার টাকাটা দিও । সুরেন্দ্রনাথ কৃতার্থ হয়ে করজোড়ে বললেন যথা আজ্ঞা ।
আবার একদিন তিনি গৃহের বাইরে শৌচে যাওয়া অসম্ভব হয়ে উঠবে একথা বলায় যুবক লাটু করজোড়ে বললেন , এমন কথা বলতে আছে মশায় , হামি তো আপনকার মেস্তর হাজির আছে ।
এইভাবে ঠাকুর স্বয়ং সবরকম সুবন্দোবস্ত করে নিলেন ----- যে যেমন ভার বইতে পারবে তাকে তেমনি দিয়ে । সকলেই একে একে এসে জড়ো হল ----- ঠাকুরের সেবায় । ঠাকুরের ভালোবাসার অমোঘ আকর্ষণ আর নরেন্দ্রর উন্নত সঙ্গ তাদের এক সূত্রে বেঁধে ফেলল । ধ্যান ভজন পাঠ সদালাপ শাস্ত্রচর্চায় পরম আনন্দে দিন কেটে যেতে লাগল ।
ঠাকুরের পথ্য প্রস্তুত করার ভার ছিল মায়ের , মা স্বয়ং দুপুরে ও সন্ধ্যার কিছু পরে ঠাকুরকে খাইয়ে আসতেন । এইসময়ে ঠাকুরের ভাইঝি লক্ষ্মীদিদি মায়ের কাছে এসে থাকতেন ।
দিনরাত্রি এক করে ছেলেরা ঠাকুরের সেবাকার্যে নিরত ছিলেন । এক রাতে স্বামীজির মন উতলা হয় ----- কিছুদিন আগে বাড়ি ফিরে মা ভাইদের বন্দোবস্ত করে আসার যে চিন্তা মনে উদিত হয়েছিল তা নিমেষে চলে গিয়ে গোপাল , শরৎ প্রভৃতি সঙ্গীদের উৎসাহিত করে বললেন , এটা ওটা করে ভগবানকে ডাকব , সাধনভজন করব তারপরে , এই ভেবে ভেবে তো বাসনাজালে জড়িয়ে পড়ছি । ঐ বাসনাতেই সর্বনাশ , মৃত্যু । ঠাকুর দেহরক্ষার সংকল্প করেছেন কি না কে জানে ----- সময় থাকতে তাঁর সেবা ও ধ্যান ভজন যতটা পারিস করে নে , নয়তো পরে অনুতাপের অবধি থাকবে না ।
স্বামীজির বৈরাগ্যপ্রবণ ধ্যানপরায়ণ মন উদ্যানবাটীর রমণীয় পরিবেশ ও পৌষের শীতরাতের স্পন্দনে স্পন্দিত হয়ে আপনাতে আপনি ডুবে যেতে থাকে । তিনি এক গাছের তলায় বাগান থেকে শুকনো কাঠ পাতা ইত্যাদি এনে অগ্নিসংযোগ করে আহুতি দিলেন পার্থিব বাসনাসমূহ । সঙ্গী সকলেরই মনে হতে থাকে সত্যই পার্থিব বাসনাসমূহ ভস্মীভূত হয়ে মন নির্মল হয়েছে । এইভাবে ঘন্টা দুই তিন কেটে যায় । অগ্নিকে শান্ত করে যখন সবাই ঘরে ফিরলেন চারটে বেজে গেছে । যাঁরা যোগ দিতে পারেননি দুঃখ করায় স্বামীজি সান্ত্বনা দিলেন , আগে থেকে ভেবে তো করা হয়নি , এবার সুযোগ হলেই আমরা ধুনি জ্বালিয়ে আত্মশোধন করব ।
অনন্ত সময়ের প্রেক্ষিতে অনন্তের পটভূমিকায় যে দীপটি সেদিন প্রজ্জ্বলিত হল সেই দীপশিখাটি আজ উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে জ্বলছে । সারা পৃথিবী জোড়া ঠাকুরের কাজ ।
এই ঘটনার কিছুদিন পরেই এল আঠেরশ ছিয়াশি সালের পয়লা জানুয়ারি । ঠাকুর ঐদিন বিশেষ সুস্থ বোধ করায় কিছুক্ষণ বাগানে বেড়াতে চাইলেন । এদিকে ছুটির দিন বলে গৃহীভক্তরাও ঠাকুরের কাছে এসে জড়ো হয়েছেন । বিকেল তিনটে । পৌষের সোনালী আলোয় বিকেল ভাসছে । সদাপ্রসন্ন প্রেমময় ঠাকুর নেমে এসেছেন বাগানে । এসে দাঁড়ালেন আমগাছটির তলায় । ত্রিশজনের বেশি লোক হাজির । কেউ বাগানে কেউবা নীচে বৈঠকখানায় বসে কথাবার্তা বলছিল । ঠাকুরকে দেখেই সকলে তাঁর কাছে এসে ঘিরে ধরেছে , প্রণাম করছে । কেউ কোনো কথা বলবার আগেই ঠাকুর গিরিশবাবুকে বলছেন , গিরিশ ! তুমি এত কথা বলে বেড়াও , তুমি কি বুঝেছ ? কি দেখেছ ? ভক্তভৈরব গিরিশ ঘোষ করজোড়ে ঠাকুরের পায়ের কাছে দুই হাঁটু ধরে বসে ভক্তি গদগদ কন্ঠে বললেন সেই কালজয়ী কথা ----- ব্যাস বাল্মীকি যাঁর ইয়ত্তা করতে পারেননি আমি তাঁর বিষয়ে অধিক আর কি বলি !
গিরিশের অন্তরের স্বচ্ছ বিশ্বাস আর ভক্তিতে প্রীত হয়ে ঠাকুর বলে উঠলেন সমবেত সকল ভক্তকে , তোমাদের আর কি বলি , আশীর্বাদ করি তোমাদের চৈতন্য হোক ।
ভক্তদের প্রতি প্রেম ও করুণায় আত্মহারা হয়ে কথাগুলি বলামাত্র ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হয়ে পড়লেন । ভক্তদের জয়ধ্বনিতে চারিদিক মুখরিত হয়ে উঠল । অর্ধবাহ্যদশায় উপস্হিত সকল ভক্তকে দিব্যশক্তিপূত স্পর্শে ধন্য করলেন । সেই স্পর্শে কেউবা বাকশক্তিরহিত হয়ে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাঁর দিকে চেয়ে রইল । কেউ মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে পুষ্পচয়ন করে তাঁর শ্রীপদে অঞ্জলি দিতে লাগল । কেউ বা অপূর্ব দর্শনে আবিষ্ট হয়ে অশ্রু সংবরণ করতে না পেরে দর দর ধারে বক্ষ ভিজিয়ে ফেলল । আবার কেউবা দিব্যহাসি তে উদ্ভাসিত হয়ে চেয়ে রইল অপলকে । কেউ বা চিৎকার করে গৃহমধ্যে যাঁরা আছেন তাঁদের ডাকতে লাগল কৃপা পাবার জন্য ।
কিছুক্ষণ এইরকম চলতে থাকার পর ঠাকুর প্রকৃতিস্থ হলে সকলে শান্তভাবে ঘরে ফিরে চলল । সামান্য কয়জনের উপস্হিতিতে এই অসামান্য লীলা অভিনীত হয়ে গেল অসীম সময়ের একটি ক্ষণে । সেই ক্ষণটুকু কালের প্রবাহে উজ্জ্বল হয়ে রইল ----- সেই ক্ষণের অনুভব অনুধ্যান দিব্যপুষ্পসুরভির মতো ছড়িয়ে পড়ছে প্রতিদিন । সেই দিব্যপ্রভায় সকল হৃদয় স্নাত হোক এই প্রার্থনা ।
আশ্চর্যের বিষয় সেদিন ঠাকুরের সন্ন্যাসী সন্তানরা কেউ উপস্হিত ছিলেন না । গৃহীদের নিয়ে ঠাকুর ব্যস্ত আছেন দেখে তাঁরা ঠাকুরের ঘরটি তখন পরিষ্কার করছিলেন ----- কর্তব্য ও সেবার এবং প্রেমের এও এক আশ্চর্য নিদর্শন । আশীর্বাদ বা কৃপার ব্যাপারে তাঁরা এতটুকু আগ্রহী ছিলেন না ------ প্রাণের ঠাকুরের ঘরটি পরিষ্কার করাতেই ছিল তখন তাঁদের প্রধান আগ্রহ ।
রামচন্দ্র দত্ত মহাশয় প্রথম এই ঘটনাটিকে ঠাকুরের কল্পতরু হওয়া বলে নির্দেশ করেন । ঠাকুরের সন্ন্যাসী ভক্তদের কেউ কেউ বলেন ঠাকুরের অভয়প্রকাশ । কারণ নির্বিচারে জনসাধারণকে অভয়াশ্রয় প্রদান ব্যক্ত হয়েছিল সেদিন । যে অভয় পরবর্তীকালে মায়ের কন্ঠে ধ্বনিত হল , আমি মা থাকতে ভয় কি বাবা ! জানবে আর কেউ না থাক তোমার একজন মা আছে ।
আরও একটি সমাপতন ----- ঠাকুর আমগাছের তলায় দাঁড়িয়ে দিব্য অনুভূতি দিলেন । ঠাকুর যে বলতেন , অত খোঁজে তোমার দরকার কি , বেশি বিচার করলে সব গুলিয়ে যায় । তুমি আম খেতে এসেছ আম খাও । বাগানে কটা গাছ , তাতে কটা ডাল , কটা পাতা ওই গুনতে গুনতেই সময় যাবে ------ বরং আম খাও , আস্বাদন কর , অনুভব কর ।
তাই একশো চৌত্রিশ বছরের কল্পতরু অনুষ্ঠানের শুভমুহূর্তে , নতুন বছরের শুভারম্ভে ঠাকুরের কাছে আমাদের প্রার্থনা হোক আমরা যেন তাঁর কৃপার যোগ্য হয়ে উঠতে পারি । অভিযোগ , অভিমান না করি পরম প্রেমময় ক্ষমাময় আমাদের প্রাণের ঠাকুরের কাছে , তাতে যে তাঁরই কষ্ট হয় । তাঁর কৃপা অনুভব করার শক্তিও তিনিই দেবেন ---- তাঁর পানে না চাওয়ালে সাধ্য কি আমাদের চাইবার । কৃপা বাতাস তো বইছেই , ঠাকুরের শ্রীমুখনিঃসৃত বাণী , পাল তুলে দে না । আমি অভয়মনে ছাড়ব তরী এই শুধু মোর দায় ------ ঠাকুর সমুখেই দাঁড়িয়ে আছেন কাণ্ডারী রূপে , গুরু রূপে , বন্ধু রূপে ---- এই বোধটি যেন সদা জাগরূক থাকে । অভিযোগ নয় , আমাদের বুঝতে হবে , ' দিনে দিনে নিতেছ আমায় সে মহাদানেরই যোগ্য করে '
#জয়ঠাকুর
#তোমাদেরচৈতন্যহোক
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস , আমাদের প্রাণের ঠাকুরের প্রকটলীলার শেষ লীলাস্হল কাশীপুর উদ্যানবাটী ।
কাশীপুর উদ্যানবাটী ছিল বিশিষ্ট জমিদার রানি কাত্যায়নীর জামাই গোপাল লাল ঘোষের সম্পত্তি। ঠাকুরের ভক্তগণ তাঁর কাছ থেকে মাসিক ৮০ টাকা ভাড়ায় প্রথমে ছয় মাস ও পরে আরও তিন মাসের জন্য বাড়িটি ভাড়া নিয়েছিলেন। উদ্যানবাটীর মোট এলাকার আয়তন ছিল ১১ বিঘার কিছু বেশি।
বাগানটি চার দিকে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। উত্তর সীমানার কাছে কয়েকটি ঘর রান্নাঘর ও ভাণ্ডারঘর হিসেবে ব্যবহৃত হত। এই ঘরগুলির সামনেই মূল দোতলা বাড়িটি অবস্থিত। এই বাড়ির নিচে চারখানি ও উপরে দুখানি ঘর আছে। উপরের বড়ো ঘরটিতে থাকতেন ঠাকুর আর ছোটো ঘরটি তাঁর স্নান ইত্যাদির জন্য ব্যবহৃত হত। বড়ো ঘরটি এখন মঠের প্রধান উপাসনালয়। বড়ো ঘরটির ঠিক নিচে একতলায় একটি হল ঘর আছে। এটি ছিল ভক্তদের বসার ঘর। এখন এটি মঠের দ্বিতীয় উপাসনালয়। এই ঘরের উত্তরে একটি সিঁড়ির ঘর আছে। তার পাশে পূর্বদিকের ঘরটিতে মা থাকতেন। এই ঘরটি এখন মা সারদা দেবীর মন্দির। হল ঘরের দক্ষিণের ঘরটিতে সেবকরা থাকতেন। এটি এখন একটি ক্ষুদ্র সংগ্রহালয়।
মূল বাড়ির পূর্বে ও পশ্চিমে সিঁড়ি আছে। বাড়িকে চার দিক দিয়ে ঘিরে আছে গোলাকার পথ। বাগানের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে উদ্যানবাটীর প্রধান ফটকটি অবস্থিত। এগুলি ছাড়াও বাগানে একটি ডোবা ও একটি বড়ো পুকুর ছিল। বাগানে আম, কাঁঠাল , লিচু ইত্যাদি নানা ফলের গাছও আছে। বাগানের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে বড়ো পুকুরটির পাশে একটি খেজুর গাছ ছিল। তাঁর ভক্ত ছেলেরা ভোরবেলা খেজুর রস খাওয়ার জন্য সেখানে গেলে অলৌকিক উপায়ে এই গাছের তলা থেকে একটি প্রচন্ড বিষধর সাপকে ঠাকুর তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এই গাছটির অবশিষ্টাংশ এখন মঠের অফিসঘরে রক্ষিত আছে।
এখানেই ঠাকুর আট মাস মতো অবস্হান করেন । ব্যাধি তাঁর পার্থিব দেহকে জীর্ণ , ভগ্ন করে দিলেও তিনি পরবর্তী মহীরূহের বীজ বপন করে অঙ্কুরিত করে দিয়েছিলেন এখানেই । ঠাকুর দক্ষিণেশ্বরে মায়ের কাছে এবং ভক্তদের কাছে বলেছিলেন , যাবার আগে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়ে যাব । জানো তো রাজা তাঁর রাজ্যে ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়ান , তারপর লোক জানাজানি হচ্ছে দেখলেই সেখান থেকে সরে পড়েন , তেমনি যখন বেশি লোকে কানাকানি করবে ( নিজের শরীর দেখিয়ে ) এই খোলটা আর থাকবে না , মায়ের ইচ্ছায় ভেঙে যাবে । কারা অন্তরঙ্গ , কারা বহিরঙ্গ তাও জানা যাবে !
নরেন্দ্রনাথসহ অন্যান্য ভক্তগণ , এমনকি মা স্বয়ং এইসব ভবিষ্যৎবাণীর সত্যতা চাক্ষুষ করে আতঙ্কিত হতেন । ঠাকুর নরেন্দ্রনাথকে এই সময়েই বিশেষভাবে পরবর্তীকালের কাজে এগিয়ে দিলেন , বললেন , মা তোকে তাঁর কাজ করবার জন্যেই সংসারে টেনে এনেছেন , তুই আর যাবি কোথায় ----- আমার পেছনে যে তোকে ফিরতেই হবে । এরা সব ( বালক ভক্তদের দেখিয়ে ) হোমাপাখির শাবক যেন , হোমাপাখি আকাশে অনেক উঁচুতে উড়ে ডিম পাড়ে । ডিম প্রবল বেগে মাটিতে পড়তে থাকে , ভয় হয় মাটিতে পড়ে ফেটে গেল বুঝি । কিন্তু তা হয় না , মাটিতে পড়ার আগেই ডিম ফুটে ছানা বেরোয় আর ডানা মেলে উড়তে শুরু করে , মাটি স্পর্শ করে না । তেমনি এরা সব সংসারে আবদ্ধ হবার আগেই ঈশ্বরাভিমুখী হবে ।
এতদিন ভক্তরা চাঁদা তুলে ঠাকুরের সেবার ব্যবস্থা করছিল । ঠাকুর এবার বলরাম বসুকে ডেকে বললেন , দেখ দশজনে চাঁদা তুলে আহারের ব্যবস্থা করবে এ বড়ো পছন্দ হয় না , এখন থেকে খাবার খরচটা তুমিই দিও ।
ভাড়া আশি টাকা ---- জানতে পেরে ঠাকুর ভাবছেন কি করে এরা চালাবে ---- পরম ভক্ত সুরেন্দ্রনাথকে বললেন , দেখ সুরেনদর এরা সব কেরাণী , মেরাণী ছা পোষা লোক । অত টাকা কেমন করে যোগাড় করবে । তুমি ভাড়ার টাকাটা দিও । সুরেন্দ্রনাথ কৃতার্থ হয়ে করজোড়ে বললেন যথা আজ্ঞা ।
আবার একদিন তিনি গৃহের বাইরে শৌচে যাওয়া অসম্ভব হয়ে উঠবে একথা বলায় যুবক লাটু করজোড়ে বললেন , এমন কথা বলতে আছে মশায় , হামি তো আপনকার মেস্তর হাজির আছে ।
এইভাবে ঠাকুর স্বয়ং সবরকম সুবন্দোবস্ত করে নিলেন ----- যে যেমন ভার বইতে পারবে তাকে তেমনি দিয়ে । সকলেই একে একে এসে জড়ো হল ----- ঠাকুরের সেবায় । ঠাকুরের ভালোবাসার অমোঘ আকর্ষণ আর নরেন্দ্রর উন্নত সঙ্গ তাদের এক সূত্রে বেঁধে ফেলল । ধ্যান ভজন পাঠ সদালাপ শাস্ত্রচর্চায় পরম আনন্দে দিন কেটে যেতে লাগল ।
ঠাকুরের পথ্য প্রস্তুত করার ভার ছিল মায়ের , মা স্বয়ং দুপুরে ও সন্ধ্যার কিছু পরে ঠাকুরকে খাইয়ে আসতেন । এইসময়ে ঠাকুরের ভাইঝি লক্ষ্মীদিদি মায়ের কাছে এসে থাকতেন ।
দিনরাত্রি এক করে ছেলেরা ঠাকুরের সেবাকার্যে নিরত ছিলেন । এক রাতে স্বামীজির মন উতলা হয় ----- কিছুদিন আগে বাড়ি ফিরে মা ভাইদের বন্দোবস্ত করে আসার যে চিন্তা মনে উদিত হয়েছিল তা নিমেষে চলে গিয়ে গোপাল , শরৎ প্রভৃতি সঙ্গীদের উৎসাহিত করে বললেন , এটা ওটা করে ভগবানকে ডাকব , সাধনভজন করব তারপরে , এই ভেবে ভেবে তো বাসনাজালে জড়িয়ে পড়ছি । ঐ বাসনাতেই সর্বনাশ , মৃত্যু । ঠাকুর দেহরক্ষার সংকল্প করেছেন কি না কে জানে ----- সময় থাকতে তাঁর সেবা ও ধ্যান ভজন যতটা পারিস করে নে , নয়তো পরে অনুতাপের অবধি থাকবে না ।
স্বামীজির বৈরাগ্যপ্রবণ ধ্যানপরায়ণ মন উদ্যানবাটীর রমণীয় পরিবেশ ও পৌষের শীতরাতের স্পন্দনে স্পন্দিত হয়ে আপনাতে আপনি ডুবে যেতে থাকে । তিনি এক গাছের তলায় বাগান থেকে শুকনো কাঠ পাতা ইত্যাদি এনে অগ্নিসংযোগ করে আহুতি দিলেন পার্থিব বাসনাসমূহ । সঙ্গী সকলেরই মনে হতে থাকে সত্যই পার্থিব বাসনাসমূহ ভস্মীভূত হয়ে মন নির্মল হয়েছে । এইভাবে ঘন্টা দুই তিন কেটে যায় । অগ্নিকে শান্ত করে যখন সবাই ঘরে ফিরলেন চারটে বেজে গেছে । যাঁরা যোগ দিতে পারেননি দুঃখ করায় স্বামীজি সান্ত্বনা দিলেন , আগে থেকে ভেবে তো করা হয়নি , এবার সুযোগ হলেই আমরা ধুনি জ্বালিয়ে আত্মশোধন করব ।
অনন্ত সময়ের প্রেক্ষিতে অনন্তের পটভূমিকায় যে দীপটি সেদিন প্রজ্জ্বলিত হল সেই দীপশিখাটি আজ উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে জ্বলছে । সারা পৃথিবী জোড়া ঠাকুরের কাজ ।
এই ঘটনার কিছুদিন পরেই এল আঠেরশ ছিয়াশি সালের পয়লা জানুয়ারি । ঠাকুর ঐদিন বিশেষ সুস্থ বোধ করায় কিছুক্ষণ বাগানে বেড়াতে চাইলেন । এদিকে ছুটির দিন বলে গৃহীভক্তরাও ঠাকুরের কাছে এসে জড়ো হয়েছেন । বিকেল তিনটে । পৌষের সোনালী আলোয় বিকেল ভাসছে । সদাপ্রসন্ন প্রেমময় ঠাকুর নেমে এসেছেন বাগানে । এসে দাঁড়ালেন আমগাছটির তলায় । ত্রিশজনের বেশি লোক হাজির । কেউ বাগানে কেউবা নীচে বৈঠকখানায় বসে কথাবার্তা বলছিল । ঠাকুরকে দেখেই সকলে তাঁর কাছে এসে ঘিরে ধরেছে , প্রণাম করছে । কেউ কোনো কথা বলবার আগেই ঠাকুর গিরিশবাবুকে বলছেন , গিরিশ ! তুমি এত কথা বলে বেড়াও , তুমি কি বুঝেছ ? কি দেখেছ ? ভক্তভৈরব গিরিশ ঘোষ করজোড়ে ঠাকুরের পায়ের কাছে দুই হাঁটু ধরে বসে ভক্তি গদগদ কন্ঠে বললেন সেই কালজয়ী কথা ----- ব্যাস বাল্মীকি যাঁর ইয়ত্তা করতে পারেননি আমি তাঁর বিষয়ে অধিক আর কি বলি !
গিরিশের অন্তরের স্বচ্ছ বিশ্বাস আর ভক্তিতে প্রীত হয়ে ঠাকুর বলে উঠলেন সমবেত সকল ভক্তকে , তোমাদের আর কি বলি , আশীর্বাদ করি তোমাদের চৈতন্য হোক ।
ভক্তদের প্রতি প্রেম ও করুণায় আত্মহারা হয়ে কথাগুলি বলামাত্র ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হয়ে পড়লেন । ভক্তদের জয়ধ্বনিতে চারিদিক মুখরিত হয়ে উঠল । অর্ধবাহ্যদশায় উপস্হিত সকল ভক্তকে দিব্যশক্তিপূত স্পর্শে ধন্য করলেন । সেই স্পর্শে কেউবা বাকশক্তিরহিত হয়ে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাঁর দিকে চেয়ে রইল । কেউ মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে পুষ্পচয়ন করে তাঁর শ্রীপদে অঞ্জলি দিতে লাগল । কেউ বা অপূর্ব দর্শনে আবিষ্ট হয়ে অশ্রু সংবরণ করতে না পেরে দর দর ধারে বক্ষ ভিজিয়ে ফেলল । আবার কেউবা দিব্যহাসি তে উদ্ভাসিত হয়ে চেয়ে রইল অপলকে । কেউ বা চিৎকার করে গৃহমধ্যে যাঁরা আছেন তাঁদের ডাকতে লাগল কৃপা পাবার জন্য ।
কিছুক্ষণ এইরকম চলতে থাকার পর ঠাকুর প্রকৃতিস্থ হলে সকলে শান্তভাবে ঘরে ফিরে চলল । সামান্য কয়জনের উপস্হিতিতে এই অসামান্য লীলা অভিনীত হয়ে গেল অসীম সময়ের একটি ক্ষণে । সেই ক্ষণটুকু কালের প্রবাহে উজ্জ্বল হয়ে রইল ----- সেই ক্ষণের অনুভব অনুধ্যান দিব্যপুষ্পসুরভির মতো ছড়িয়ে পড়ছে প্রতিদিন । সেই দিব্যপ্রভায় সকল হৃদয় স্নাত হোক এই প্রার্থনা ।
আশ্চর্যের বিষয় সেদিন ঠাকুরের সন্ন্যাসী সন্তানরা কেউ উপস্হিত ছিলেন না । গৃহীদের নিয়ে ঠাকুর ব্যস্ত আছেন দেখে তাঁরা ঠাকুরের ঘরটি তখন পরিষ্কার করছিলেন ----- কর্তব্য ও সেবার এবং প্রেমের এও এক আশ্চর্য নিদর্শন । আশীর্বাদ বা কৃপার ব্যাপারে তাঁরা এতটুকু আগ্রহী ছিলেন না ------ প্রাণের ঠাকুরের ঘরটি পরিষ্কার করাতেই ছিল তখন তাঁদের প্রধান আগ্রহ ।
রামচন্দ্র দত্ত মহাশয় প্রথম এই ঘটনাটিকে ঠাকুরের কল্পতরু হওয়া বলে নির্দেশ করেন । ঠাকুরের সন্ন্যাসী ভক্তদের কেউ কেউ বলেন ঠাকুরের অভয়প্রকাশ । কারণ নির্বিচারে জনসাধারণকে অভয়াশ্রয় প্রদান ব্যক্ত হয়েছিল সেদিন । যে অভয় পরবর্তীকালে মায়ের কন্ঠে ধ্বনিত হল , আমি মা থাকতে ভয় কি বাবা ! জানবে আর কেউ না থাক তোমার একজন মা আছে ।
আরও একটি সমাপতন ----- ঠাকুর আমগাছের তলায় দাঁড়িয়ে দিব্য অনুভূতি দিলেন । ঠাকুর যে বলতেন , অত খোঁজে তোমার দরকার কি , বেশি বিচার করলে সব গুলিয়ে যায় । তুমি আম খেতে এসেছ আম খাও । বাগানে কটা গাছ , তাতে কটা ডাল , কটা পাতা ওই গুনতে গুনতেই সময় যাবে ------ বরং আম খাও , আস্বাদন কর , অনুভব কর ।
তাই একশো চৌত্রিশ বছরের কল্পতরু অনুষ্ঠানের শুভমুহূর্তে , নতুন বছরের শুভারম্ভে ঠাকুরের কাছে আমাদের প্রার্থনা হোক আমরা যেন তাঁর কৃপার যোগ্য হয়ে উঠতে পারি । অভিযোগ , অভিমান না করি পরম প্রেমময় ক্ষমাময় আমাদের প্রাণের ঠাকুরের কাছে , তাতে যে তাঁরই কষ্ট হয় । তাঁর কৃপা অনুভব করার শক্তিও তিনিই দেবেন ---- তাঁর পানে না চাওয়ালে সাধ্য কি আমাদের চাইবার । কৃপা বাতাস তো বইছেই , ঠাকুরের শ্রীমুখনিঃসৃত বাণী , পাল তুলে দে না । আমি অভয়মনে ছাড়ব তরী এই শুধু মোর দায় ------ ঠাকুর সমুখেই দাঁড়িয়ে আছেন কাণ্ডারী রূপে , গুরু রূপে , বন্ধু রূপে ---- এই বোধটি যেন সদা জাগরূক থাকে । অভিযোগ নয় , আমাদের বুঝতে হবে , ' দিনে দিনে নিতেছ আমায় সে মহাদানেরই যোগ্য করে '
#জয়ঠাকুর